হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও সচ্ছলতা মিলছে না চা শ্রমিকদের

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলায় অবস্থিত পাঁচটি চা বাগানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। এই জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী— যারা প্রতিকূল পরিবেশেও পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্থনীতিতে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এ নারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই প্রতিদিন চা বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাকিরা কেউ কেউ মাধবপুরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্পকারখানায় বা কৃষিজমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের পরও জীবনে আসেনি আর্থিক সচ্ছলতা কিংবা সামাজিক মর্যাদা।
চা বাগানের নারী শ্রমিকদের জীবনের গল্প এক অনন্ত সংগ্রামের কাহিনী। কিশোর বয়সেই শুরু হয় তাদের কর্মজীবন। পরিবারে অভাব, অল্প শিক্ষার সুযোগ, আর বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে ছোটবেলা থেকেই বাগানের মাঠে ঝুঁকে পড়ে চা পাতার ঝুড়ি হাতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রম করলেও মজুরি এতটাই কম যে, পরিবারের তিনবেলা খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়ে।
নোয়াপাড়া চা বাগানের শ্রমিক শেফালী রেলি বলেন, “আমাদের জীবনে নেই কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বা মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা। বাগানে চিকিৎসা কেন্দ্র থাকলেও তা অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। গর্ভবতী শ্রমিকদের জন্য নেই মাতৃত্বকালীন ছুটি বা আর্থিক সহায়তা। ফলে অনেক নারী গর্ভকালেও কাজ করতে বাধ্য হন।”
স্বাস্থ্যসেবার অভাব ও পুষ্টির ঘাটতির কারণে অনেক নারী অল্প বয়সেই দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। বৈকুন্ঠপুর চা বাগানের শ্রমিক বিমলা চৌহান বলেন, “আমাদের দিন শুরু হয় ভোর ৪টার আগেই। পরিবারের সব কাজ শেষ করে সকাল ৮টার মধ্যেই কাজে যেতে হয়। রোদ-বৃষ্টি, ঠান্ডা-গরম- কোনো কিছুই বাধা হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুঁকে চা পাতা তোলার কাজ শুধু শরীর নয়, মনকেও ক্লান্ত করে।”
দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে তারা ঘরে ফেরে- কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই। মাথায় গরুর ঘাস, লাকড়ি বা পানির কলসি নিয়ে বাগানের পথ ধরে হাঁটে তারা। এরপর আবার শুরু হয় ঘরের কাজ- রান্না, কাপড় ধোয়া, সন্তানদের দেখাশোনা। পরদিন ভোরেই আবার একই চক্র।
জগদীশপুর চা বাগানের কমলা সাঁওতাল বলেন, “আমরা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখি, তবুও আমাদের শ্রমের মূল্যায়ন নেই। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা উন্নয়ন কর্মসূচি- কিছুই নেই আমাদের জন্য।”
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, “চা বাগানের নারী শ্রমিকদের উন্নয়নে সরকার ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, পুষ্টিকর খাবার এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রসার ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জাহিদ বিন কাশেম বলেন, চা বাগানের নারী-পুরুষ শ্রমিকদের স্বাবলম্বী করতে সরকার নগদ অর্থ, গবাদি পশু, হাঁসমুরগি, টিউবওয়েলসহ নানা অনুদান দিচ্ছে। তাদের জীবনযাত্রা আগের তুলনায় এখন অনেক উন্নত হয়েছে।
